তুলু উশ শামস একজন ক্রীড়া সংগঠক। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে তিনি কারাতের সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। এতো বছরের কারাতে জীবনে তিনি সর্বদা কারাতের উন্নয়নের কথা ভেবে গেছেন। বর্তমানে তুলু উশ শামস বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক পদে নিয়োজিত আছেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ কারাতের রেফারি কমিশনের চেয়ারম্যান। এ গুণী মানুষটি একান্ত সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়েছেন বাংলাধারার সাথে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন বাংলাধারার নিজস্ব প্রতিবেদক হাসান সৈকত।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: কেমন আছেন আপনি?
তুলু উশ শামস: আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: আমরা জানি আপনি সব সময় অনেক ব্যস্ত সময় পার করেন। আপনার ব্যবসা, চাকরি ও পরিবারকে সময় দেওয়ার পর কারাতের চর্চা ও প্রশিক্ষণে কীভাবে সময় দেন?
তুলু উশ শামস: আমার কাছে সব সময় একটা কথাই মনে হয়েছে, মানুষের ইচ্ছাশক্তির ওপরে কিছু নেই। মানুষ আজ পর্যন্ত যে জায়গায় এসেছে তার পেছনে মানুষের ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। যেখানে মানুষের প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকে সেখানে মানুষ সফল হয়। আমি যেভাবে আমার নিজের জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছি, যে কাজের প্রতি আমার প্রবল ইচ্ছাশক্তি আছে সে কাজ অন্যান্য এতো সব কাজের মাঝেও সমন্বয় করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ইচ্ছাশক্তি থাকলে, চাইলেই সবকিছু একসাথে করা সম্ভব। এজন্য শুধু সময়টাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে জানতে হবে।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: আপনি কত বছর যাবৎ কারাতের সাথে সম্পৃক্ত আছেন?
তুলু উশ শামস: সঠিকভাবে বলা খুব মুশকিল। খুব সম্ভবত ২৭-২৮ বছর ধরে আমি কারাতের সাথে সম্পৃক্ত আছি।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: কি মনে করে কারাতে’তে যোগদান করেছিলেন?
তুলু উশ শামস: আট-দশটা সাধারণ মানুষের মতই মার্শাল আর্টের প্রতি একটা ঝোঁক ছিল। তখন অল্প বয়স, টিভিতে চাইনিজ সিনেমাগুলোতে মার্শাল আর্ট দেখেই এর প্রতি আমার আগ্রহ জন্মায়। তখন নিজেকে নায়ক ভাবার একটা প্রবণতা ছিল। সিনেমায় নায়কদেরকে অনেক কিছু করতে দেখা যেত, যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে ছিল। যেহেতু নিজের মধ্যে নিজেকে নায়ক ভাবার একটা প্রবণতা ছিল আর সেই কাজকে বাস্তবায়িত করতেই কারাতেতে ভর্তি হওয়া।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: আপনি এত বছর ধরে কারাতের সাথে সম্পৃক্ত আছেন, সেক্ষেত্রে কারাতে থেকে আপনার অর্জন গুলো কি কি?
তুলু উশ শামস: আসলে অর্জন বলাটা খুব কঠিন, কারণ আমার অর্জন মূল্যায়ন করবে মানুষ। তারপরেও যদি বলতে হয়, কারাতে খেলোয়াড় হিসেবে আমার যা অর্জন তা বিশাল কিছু নয়। প্রথম কারণ হচ্ছে আমরা যে সময়টাতে কারাতে করেছি, ক্রীড়া হিসেবে কারাতে এখন যতটা জনপ্রিয় তখন কিন্তু অতটা ছিল না। তখন কারাতে আত্মরক্ষার একটি কৌশল হিসেবেই পরিচিত ছিল। কারাতেকে এভাবে দেখেই আমাদের যুবক বয়সের অনেকটা সময় কেটেছে। তবে বর্তমান সময়ে কারাতে শুধুমাত্র আত্মরক্ষার কৌশলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, কারাতে এখন একটি খেলা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে কারাতের বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। এমনকি আন্তর্জাতিক বিশ্বেও এখন কারাতের জনপ্রিয়তা ব্যাপক।
তবে একদম নেই তাও কিন্তু বলা যাবে না, জাপানে ২০০৫ সালে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে আমি বাংলাদেশের হয়ে খেলেছি। এছাড়াও আমি একাধিকবার চট্টগ্রাম জেলার কারাতে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। জাতীয় পর্যায়েও আমার পদক আছে।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: এমনকি কখনো হয়েছে, এই কারাতের প্রয়োগ বাইরে সাধারণ মানুষের উপর করেছেন?
তুলু উশ শামস: আমার কখনোই কারো উপর প্রয়োগের প্রয়োজন পড়েনি। যারা খুব ভালোভাবে কারাতে প্রশিক্ষণ করে বা যারা কারাতের মূল বিষয়গুলোর ওপর ধারণা রাখে তাদের কারোরই রাস্তায় মারামারি করার প্রয়োজন হয় না। যারা কারাতে করে তারা কখনোই প্রথমে অ্যাটাক করে না। কারাতে ডিফেন্সিব আর্ট। ডিফেন্সিব আর্ট হলে তো কারো সাথে মারামারিতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কারাতে আপনাকে শেখায় এমন কোনো কাজে লিপ্ত হবেন না যেখানে মারামারির সম্ভাবনা আছে। গত ১৫-২০ বছরে বাংলাদেশ কারাতেতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। আমি মনে করি, এটার মূল কৃতিত্বের দাবিদার আমাদের জেনারেশনের বেশ কয়েকজন। বাংলাদেশে প্রথম কারাতে যখন চালু হয়েছিল তখন কারাতেতে শিক্ষিত মানুষের আনাগোনা খুব কম ছিল। কারাতে শুধু অনুশীলন করলেই হয় না, এতে শিক্ষার অনেক ব্যাপার আছে। কারাতেকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে নিজেকে সচেতন ও শিক্ষিত হতে হবে। তৎকালীন যারা কারাতে করতো তারা অতোটা সচেতন ছিলেন না। ফলে তখনকার ধারণা ছিল কারাতে হয়তো মারামারির বিষয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা অনেক বেশি কিছু জানি, কারাতের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা অনেক লেখাপড়া করেছি। ফলে এখনকার সময়ে আমরা যারা আছি তারা শুধু শারীরিকভাবেই কারাতের বিষয়টাতে অভিজ্ঞ তা না, তারা জানেন কিভাবে কারাতেকে একটা জীবন দর্শন হিসেবে ছেলে মেয়েদের কাছে পৌছে দেওয়া যায়। কারাতের একটা বড় দিক হচ্ছে, কারাতে ছেলে মেয়েদেরকে অনেক বেশি সংযমী, ধীর-স্থির এবং সুশৃঙ্খল করে তোলে। কারাতে শেখার পর আমি খুব স্পষ্টভাবে জানি আমার সক্ষমতা কতটুকু। আমি যদি কাউকে মারি তার পরিণতি কতটুকু খারাপ হবে। যেখানে আমি আমার ক্ষমতা সম্পর্কে জানি সেখানে আমার পরিক্ষা করার তো কিছু নেই। কারাতে নিয়ে সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনা আগের তুলনায় অনেক বেশি পরিবর্তন হয়েছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশে যে পরিমাণ ছেলে-মেয়ে কারাতের চর্চা করে তা ক্রিকেট ফুটবলের তুলনায় অনেক বেশি। কারাতে একটা ইনস্টিটিউশনাল ট্রেনিং। ক্রিকেট ফুটবল আপনি যেকোনো জায়গায় খেলতে পারবেন তবে কারাতে প্রশিক্ষনের জন্য একটা ইনস্টিটিউট প্রয়োজন। প্রয়োজন সংগঠিত প্রশিক্ষণের। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার স্কুল কলেজগুলোতে কিছু খেলা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। যার মধ্যে কারাতে অন্যতম।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: বর্তমানে কি কি করছেন কারাতে নিয়ে?
তুলু উশ শামস: আপনি বলেছেন আমি একজন ক্রীড়াবিদ। তবে আমি নিজেকে একজন ক্রীড়া সংগঠক বলতেই বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কারাতের গত ২০ বছরে যে পরিবর্তন এসেছে আমি মনে করি আমার সহকর্মীরাসহ আমাদের জেনারেশন এই পরিবর্তনটা এনেছে। সেক্ষেত্রে আমি নিজেকে কারাতে সংগঠক হিসেবে পরিচয় দিতে অনেক বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যেহেতু সংগঠক হিসেবে আমার অনেকটা সময় কেটেছে চট্টগ্রামে, আমি প্রায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরে সংগঠক হিসেবে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাথে জড়িত। চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থায় কারাতের যে কার্যক্রমগুলো হতো তার বেশির ভাগেরই সাংগঠনিক কাজ আমার হাত ধরেই হয়েছে। ফলে চট্টগ্রামে দীর্ঘ সময় ধরে আমি কারাতে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছি। বর্তমানে আমি বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদকের কাজে নিয়োজিত আছি। ফেডারেশনের সিদ্ধান্তে আরও বেশকিছু দায়িত্ব নিতে হয়েছে আমাকে। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি জাতীয় পর্যায়ে একটা বড় পরিবর্তন আনার সুযোগ আমার হাতে আছে। বর্তমানে আমাদের কারাতের যে নির্বাহি কমিটি আছে তা আগের যেকোনো কমিটির চাইতে অনেক বেশি গতিশীল এবং কারাতের বিষয় বস্তু নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে আমরা কারাতে অঙ্গনে বিশাল এক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবো। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অন্তত সাফ গেমসে আমাদের পদকের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: ক্রিকেট এবং ফুটবলের মতো কারাতেকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কী?
তুলু উশ শামস: এখনো বাংলাদেশের কনটেস্টে এটা খুব কঠিন। কারণ পপুলার কনসেপ্ট বলে একটা ব্যাপার আছে। আমি মনে করি ফুটবলাররাও ক্রিকেটারদের মতো এতো পয়সা কামায় না। অথচ ক্রিকেটের তুলনায় ফুটবল বাংলাদেশের আদি খেলা। বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটের প্রতি অনেক বেশি আবেগপ্রবণ। আর যেদিকে মানুষের আবেগ থাকবে সেদিকে কমার্সিয়াল ইন্টারেস্ট থাকবে, এটাই বাস্তবতা । ক্রিকেটের পেছনে অনেক বেশি অনুদানও আসছে। তার তুলনায় ফুটবল অতোটা পায় না। সেই দিক থেকে কারাতের কথা বলতে গেলে কারাতেকে পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো ওই জনপ্রিয়তা কারাতে এখনো পায়নি। আমি মনে করি, কারাতেকে ক্রিকেটের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন একটা কাজ। তবে বিভিন্নভাবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্রীড়া ও ক্রিড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। উনার শুধু ক্রীড়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ আছে তা না, উনি এটা পট্রোনাইজ করেন সক্রিয়ভাবে। তবে কারাতেকে পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে অবশ্যই এইটা দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকবে না।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কারাতের অর্জন কেমন?
তুলু উশ শামস: প্রথমে বলতে হবে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে অন্যান্য খেলার মতো এত বড় অনুদান কখনো আসেনি। যেহেতু আসেনি সেহেতু ওদের সাথে কম্পেয়ার করার মতো অর্জন নেই আমাদের। তবে আমাদের বাস্তবিক লক্ষ্য মাত্রা হচ্ছে আগামী ৩ বছরের মধ্যে কারাতে অঙ্গনে বাংলাদেশ সাউথ এশিয়ান লেভেলে এক নম্বরে থাকতে হবে। ছোট ছোট লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করে করে এগুতে হবে। হুট করেই বড় লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করা কখনোই বাস্তবসম্মত না। তবে আমাদের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ অর্জন সাফ গেমস। গতবারেও সাফ গেমসে আমাদের স্বর্ণ পদক অর্জন ছিল। তার ভেতরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্বর্ণ পদক অর্জন করেছিল বাংলাদেশ।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: প্রত্যেক ক্রীড়া প্রশিক্ষক চায় নিজের ছাত্র যাতে একটা ভালো জায়গায় যায়, সেক্ষেত্রে আপনার ছাত্রদের কাছ থেকে আপনি কেমন অর্জন আশা করেন?
তুলু উশ শামস: আমি জাতীয় ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক। আমার জন্য পুরো বাংলাদেশের সব স্টুডেন্টই আমার স্টুডেন্ট। ব্যক্তিগতভাবে আমার স্টুডেন্ট কি অর্জন করলো তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না, আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমার দেশ। আমার জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা যখন ভালো করবে সেটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আমি ব্যক্তিগত সাফল্যকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখি না, ব্যক্তিগত সাফল্য খুব বেশি দীর্ঘমেয়াদি না। আমার নিজের স্টুডেন্টরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদক অর্জন করেছে। তবে আমার জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদক অর্জন করে ওইটাই আমার সব চাইতে বড় প্রাপ্তি।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: আপনি কতটুকু সফল হতে পেরেছেন?
তুলু উশ শামস: আমি এখনো একটা বিষয় দ্বিমত করি, তা হলো আমি এখনো চলমান দায়িত্বে আছি। আমার সাফল্য বিবেচনা করবে আমার পরবর্তী জেনারেশন। আমি আদো কি সফল? তা বুঝতে পারবো আরো অনেক পরে। যেহেতু চলমান দায়িত্বে আছি, দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর পেছনে তাকালে বুঝতে পারবো আমি কতটুকু সফল। কারণ আমার থেকে আমার পরবর্তী জেনারেশন যদি আরো উত্তম কিছু করতে পারে ওইটা আমার জন্য অর্জন।
বাংলাধারা প্রতিবেদক: অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, বাংলাধারাকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় দেওয়ার জন্য।
তুলু উশ শামস: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।