আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার নুরুল আলাল (৩৫) ছিলেন প্রতিশ্রুতিশীল এক যুবক। উপজেলার বড় মহেশখালী ইউনিয়নের মিয়াজির পাড়ার মোহাম্মদ শফি ও বেগম শফি দম্পতির ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ের মাঝে সবার বড় আলাল। বোনদের বিয়ে দিয়ে বাবা-মা, চার ভাই ও স্ত্রী এবং দুই সন্তান নিয়ে পরিবারের ১০ সদস্যের ভরণ-পোষণে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় উচু বেতনে চাকরি করতেন তিনি। সুখী পরিবার হিসেবে এলাকায় ভালোই নাম ছিল তাদের। কিন্তু ভয়াবহ একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আলাল প্রাণে বাঁচলেও পা হারিয়ে দুঃসহ যন্ত্রণার নিঃস্ব জীবন কাটাচ্ছেন এখন। দুই বছরের মেয়ে তাসনিয়া আলাল ও দশ মাসের ছেলে তাসনিম আলালসহ চিকিৎসাধীন স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালেই দিন কাটছে আলালের স্ত্রী হীনু আরার।
সেদিন কী ঘটেছিল? জানতে চাইলে আলাল বলেন, গত ২ জুন রাত তখন প্রায় সাড়ে তিনটা। অধিকাংশ যাত্রী ঘুমাচ্ছিলেন। তিনিও (নুরুল আলাল) কিছুটা ঘুমের মধ্যেই ছিলেন। তাদের বহনকারী সৌদিয়া পরিবহনের গাড়িটি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ছুটছিল। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলে দেখেন, বেপরোয়া গতিতে ছুটছে বাস। যাত্রীরা ভয় পেয়ে সামলে গাড়ি চালাতে চালককে অনুরোধ করছিলেন বার বার। কিন্তু তিনি (চালক) কারো কথায় কর্ণপাত না করে গতি বাড়িয়ে চালায়, অকস্মাৎ চট্টগ্রামগামী একটি ট্রাকের পিছনে ধাক্কা লেগে যায় তাদের বহনকারী সৌদিয়া পরিবহনের। এতে বাসের সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। গাড়ির হেলপার ঘটনাস্থলে মারা যান। আমি এক সিট পেছনে বি-সিরিয়ালে বসেছিলাম। তার ডান পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে তিনটি সুক্ষ্ম রক্তনালী অবিশিষ্ট থেকে হাটুর নিচে পা-টা কাটা পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাই
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা আলাল আরো বলেন, বদলি হওয়া চাকুরির সুবাদে ঢাকায় বউ বাচ্চা নিয়ে আসতে বাসা ভাড়া করেছিলাম। পহেলা জুন থেকে বাসায় উঠার কথা। এদিন (পহেলা জুন) বৃহস্পতিবার অফিস শেষে রাত সোয়া ১১টার সৌদিয়া পরিবহনের বাসে (চট্র মেট্রো-ব-১১-০৬৯৮) বি-৪ সিট নিয়ে ঢাকা থেকে মহেশখালীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে শেষ রাতে বাস চালকের অপেশাদারি আচরণে মাত্র কয়েক মিনিটের এক দূর্ঘটনায় বাস দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আমি ও পরিবারের স্বপ্নও চুরমার হয়ে যায়। এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে নিজ ও ছোট্ট দুটি বাচ্চার ভবিষ্যৎও।
আলালের বাবা মোহাম্মদ শফি বলেন, চট্টগ্রামের বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন বিষয়ে স্নাতক এবং সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে আলাল। আইন পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠার আগেই পারিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় যোগ দিয়েছিল। ছোট ভাই-বোন সবাইকে উচ্চ শিক্ষিত করিয়েছে। পারিবারিক স্বচ্ছলতার পর দুই অবুঝ শিশুর ভবিষ্যত গড়তে বদলি পেয়ে ঢাকায় গিয়েছিল। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাইয়ে গত ২ জুন রাতে যাত্রীবাহি সৌদিয়া বাসটি ট্রাকে ধাক্কায় সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে তাদের পরিবারের। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় প্রাণে বাঁচলেও একটি পা কেটে ফেলতে হলো আলালের।
আলালের স্ত্রী হীনু আরা বলেন, আমরা প্রতিবেশী ইউনিয়নের বাসিন্দা। একসাথে চট্টগ্রাম অবস্থানকালীন সহযোগিতা দিয়ে আমাকেও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করিয়েছে আলাল। সবাইকে সহযোগিতা দিয়ে পরিচ্ছন্ন ভাবে চলার স্বপ্ন দেখা আলাল এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাঁদছে। নিজের অজান্তেই পা হারানোর কথা ভুলে বিছানা থেকে উঠে পা-বাড়াতে গিয়ে ফ্লোরে পড়ে ব্যাথায় কাতরান। এটা অসহ্য লাগছে। বাচ্চারা কোলে নিয়ে হাটার বায়না ধরলে তাদের নিতে না পেরে চোখের পানি ছেড়ে দেন আলাল। এসব দেখে কলিজা মুছড় দিয়ে উঠে।
তিনি আরো জানান, ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কথা মনে করে রাত বিরাতে কাঁদেন আলাল। দুই দফা অস্ত্রোপচারে ডান পা হাঁটুর উপর পর্যন্ত কেটে ফেলেছেন চিকিৎসকরা। এরপরও পরিপূর্ণ সেরে উঠেনি। এখনো ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন। আবারো অস্ত্রোপচারের কথা বলা হচ্ছে। বাম পায়ের আঘাত এখনও ভালো হয়নি। গুরুতর আহত হয়ে বেঁচে গেলেও- এখন পুরোপুরি পরনির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে হচ্ছে একসময়ের স্বনির্ভর আলালকে।
আহত আলাল আক্ষেপের সুরে বলেন, এতবড় একটি দুর্ঘটনার পর যানবাহন মালিক, তাদের সমিতি কিংবা শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর কেউই আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। এ পর্যন্ত চার লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। সামনের দিনে আরও কত টাকা খরচ হবে জানা নেই। চাকরি স্থল হতে সহমর্মিতা না পেলে চিকিৎসায় এতদূর আসা অসম্ভব ছিল। সৌদিয়া পরিবহনের সাথে যোগাযোগ করা হলেও কোনা সাড়া পাওয়া যায়নি।
আলালের পরিবারের মতে, কর্মঠ আলাল দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে পরনির্ভরশীল হয়েছে। অবুঝ শিশু দুটির দিকে তাকাতেই আলালের চোখে অশ্রু টলটল করে। দুই বছরের মেয়ে তাসনিয়া জিজ্ঞেস করে- বাবা তুমি আমাকে নিয়ে হাঁটবেনা? আলাল বাচ্চা দু’টির জন্য কৃত্রিম পা লাগিয়ে হলেও আবার হাঁটতে চায়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ হতে ক্ষতিপূরণ প্রত্যাশা করেন তারা। এব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং আইনজীবীদের সহযোগিতা চেয়েছেন আলাল ও পরিবারের সদস্যরা। পাশাপাশি রাষ্ট্রের কাছে নিরাপদ জীবনের পাশাপাশি নিরাপদ মৃত্যুর নিশ্চয়তা আশা করেন তারা।
জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানার এস.আই মাহফুজুর রহমান জানান, দূর্ঘটনার বিষয়ে সৌদিয়া পরিবহনকে অভিযুক্ত করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ৯৮/১০৫ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে (মামলা নং- ৩(০৬)২৩)। উক্ত মামলা মূলে সৌদিয়া পরিবহনের বাস এবং ট্রাক জব্দ করলেও সৌদিয়া পরিবহনের ড্রাইভারকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি বলে জানান তিনি।
সৌদিয়া পরিবহনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) কফিল উদ্দিন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ এখন সরকারের হাতে। ওইদিনের দুর্ঘটনায় আমাদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এরপরও আলালের পরিবার যোগাযোগ করলে আমার ব্যক্তিগত ফান্ড হতে সহযোগিতার চেষ্টা করবো। এ জন্য তিনি সৌদিয়া পরিবহনের কক্সবাজার অঞ্চলের ব্যবস্থাপকের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।