টানা পাঁচদিনের ভারী বর্ষণে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় বিধ্বস্ত হয়েছে পাহাড়ের পাদদেশে থাকা কিছু পরিবারের বসতঘর। আর বৃষ্টি হলেই শঙ্কা বেড়ে যায় পাহাড়ের পাদদেশে থাকা সেসব বাসিন্দাদের জানমাল। গত কয়েকদিনে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে সে শঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে আরও কয়েকগুণ।
টানা বৃষ্টিপাতে গতকাল রোববার (৬ আগস্ট) উপজেলার পারুয়া ইউনিয়নে ৬ নম্বর ওয়ার্ড জঙ্গল পারুয়া এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। সে ঘটনা রাতে ঘটলেও প্রাণ নিয়ে কোনোমতে সরে যায় পাহাড়ের ধসে পড়া মাটিতে বিধ্বস্ত হওয়া ১০ পরিবারের অর্ধশতাধিক বাসিন্দা।
জানতে চাইলে এ বিষয়ে পারুয়া ইউপি চেয়ারম্যান একতেহার হোসেন জানান, যেসব পরিবারের পাহাড় ধসের সম্মুখীন হয়েছে তাদেরকে সরিয়ে আনা হয়েছে। আর যারা ঝুঁকিতে রয়েছে তাদেরকেও সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আশা করা যায় পরবর্তীতে এ ধরনের কোনো ঘটনার সুত্রপাত হবে না। আমার এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তরা হলেন- সোনাইছড়ি খালের উত্তর অংশের মোহাম্মদ মান্নান, নাছিমা আক্তার, আব্দুল গফুর ও মোহাম্মদ জামাল এবং দক্ষিণ পাড়ে মোহাম্মদ নাছের, মোহাম্মদ পারভেজ, নুরুল ইসলাম, আব্দুল মালেক, আবুল কালাম ও মোহাম্মদ সবুজ।
এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই একইদিন রোববার রাত ও সোমবার দিনে পাহাড় ধসে পড়ে আবারও বসতি বিধ্বস্তের সম্মুখীন হয় চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের ১৪টি পরিবার। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সে ঘটনায় কোনোমতে প্রাণে বাঁচে ঘরে থাকা বাসিন্দারা।
জানা যায়, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে ১০ হাজার পরিবারের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। এসব পরিবার পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতঘর গড়ে তুলেছে।
প্রতিবছর বর্ষা এলেই এসব পরিবারকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন। বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং, মসজিদে মাইকিং করা’সহ নানানভাবে সচেতন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রশাসন। তবে কোনোভাবেই এসব পরিবারকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হতে সরাতে পারেনি প্রশাসনের লোকজন। ফলে ঘটছে পাহাড় ধসের মতো ভয়ংকর ঘটনা। তারপরেও থেমে নেই পাহাড়ের পাদদেশে উঁচু-নিচু করে ঘর তৈরী।
রাঙ্গুনিয়ার ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার। বর্ষা মৌসুম আসায় পাহাড়ে বসবাসকারী এসব পরিবারের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তারপরও থামছে না বা থামাতে পারেনি পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন। তবে বর্ষা এলেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। অন্যদিকে সারা বছর পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন নিয়ে প্রশাসন অনেকটাই নির্বিকার থাকে। চলতি বর্ষা মৌসুমে রাঙ্গুনিয়ায় আবারও পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষতির শঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে।
ইতোমধ্যেই উপজেলার চন্দ্রঘোনার বনগ্রাম, গুমাই বিল, উত্তর রাঙ্গুনিয়া ডিসি সড়ক, পারুয়া ডিসি সড়ক, বোগাবিল, বেতাগী ইউনিয়ন ও পোমরা ইউনিয়নের বিভিন্ন মাঠ-ঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। ছোট-বড় পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশকিছু অভ্যন্তরীণ সড়ক। সবমিলিয়ে চলতি বর্ষা মৌসুমে টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের এম এ হান্নান আশ্রয়ন প্রকল্প, সত্যপীর মাজার গেইট এলাকা, বেতাগী, পৌরসভার বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চল, চন্দ্রঘোনার বনগ্রাম, সরফভাটা, শিলক, পদুয়া, স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া, পারুয়া, হোছনাবাদ, নিশ্চিন্তাপুর’সহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার। তবে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও দারিদ্রের কারণে পাহাড়ে থাকতে বাধ্য বলে জানিয়েছেন বেশকিছু পরিবার।
বিগত ২০১৭ সালের জুন মাসে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নে পাহাড় ধসে নারী-শিশুসহ ৪ পরিবারের ২২ জন মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল। এমনসব বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেও উপজেলার হাজার হাজার মানুষ এখনও পাহাড়ে বসবাস করছেন। যার প্রায় অর্ধেক মানুষ পাহাড়ের ঢালুতে ভূমিধসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
পরিসংখ্যান বলছে রাঙ্গুনিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ এলাকাজুড়ে রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল। ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পাহাড়ে বসবাসকারী এসব বাসিন্দাদের সরে যেতে একাধিকবার নির্দেশনা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ। প্রশাসন এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদের নানা চেষ্টাতেও পাহাড় থেকে সরিয়ে আনা যাচ্ছে না এসব অবৈধ বসবাসকারীদের।
এ বিষয়ে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতাউল গণি ওসমানী জানান, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা বাসিন্দাদের সরে যেতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। এছাড়াও স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদে মাইকিংয়ের মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে। এতকিছুর পরেও যদি কেউ না সরে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।