spot_imgspot_img
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিবন্ধিত। রেজি নং-৯২
মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
প্রচ্ছদকক্সবাজার‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ক্রিমিনালের আঁতুড় ঘর, মাদকের আখড়া’

‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ক্রিমিনালের আঁতুড় ঘর, মাদকের আখড়া’

কক্সবাজার প্রতিনিধি
spot_img

কক্সবাজারের সদ্য বিদায়ী সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেছেন, কক্সবাজারের প্রধান সমস্যা মাদক চোরাচালান। বর্তমানে এখানকার আদালতে ১০ হাজারেরও বেশি মাদক মামলা চলমান রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অপরাধী তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে।

শনিবার (১২ আগস্ট) দুপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সম্মেলন কক্ষে কক্সবাজার নাগরিক ফোরাম আয়োজনে বিদায়ী সংবর্ধনায় জেলা জজ এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন- মাদক, অস্ত্র ও খুনের মামলায় রোহিঙ্গা আসামিদের জামিন নিতে কিছু আইনজীবী ও দালাল কোটি কোটি টাকার লেনদেন করছে। তারা জজ কোর্টে জামিন না পেলে হাইকোর্টে যান। রোহিঙ্গাদের অপরাধের কারণে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে কক্সবাজারের। ক্যাম্পগুলো এখন ইয়াবা কারবারিদের মুল কেন্দ্র। মাদকের মামলা নিষ্পত্তির জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে বিদায়ী সংবর্ধনায় জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল কক্সবাজারে সাড়ে তিন বছর দায়িত্ব পালনকালে নানা অভিজ্ঞতা, বিচারাঙ্গনে নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন।

কক্সবাজারের বিদায়ী সিনিয়র জেলা জজ ইসমাইল বলেন, কৃষিপ্রধান দেশ হয়েও আমাদের উৎপাদন যোগ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কৃষিপণ্য আমদানি করতে হয়। গ্রামাঞ্চলের কৃষি উৎপাদনে সম্পৃক্তদের বিশাল এক অংশকে কোনো না কোনো মামলায় জড়ানো হয়। এদের সিংহভাগই নির্দোষ। আসামী হয়ে সারাবছর কোর্ট-আদালতে ধর্ণা দিতে ব্যস্ত থাকায় উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। এভাবে মামলা দেশের উৎপাদনকেও বাধাগ্রস্ত করছে।

তিনি আরও বলেন, দেশে সবচেয়ে হত্যা মামলা বেশি কক্সবাজারে। এরমধ্যে রোহিঙ্গাদের কারণে খুন-খারাবিসহ নানা অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। আমি কক্সবাজারে যোগদানকালে বিচার শেষ না হওয়া ৯৯৮টি হত্যা মামলা ছিল। শুধুমাত্র রোহিঙ্গা হত্যা মামলা রয়েছে ১৫০টি। ইয়াবার মামলা রয়েছে ১০ হাজার। এসব নিয়ে জামিন বাণিজ্যও চলছে রমরমা। অনেক আইনজীবী তদবির করতে আসেন জামিন দেয়ার জন্য। পাঁচ শতাধিক মিস মামলা জমা রেখেছি। এসব মামলায় জামিন দিতে অনেকে তদবির করেছেন প্রতিনিয়ত।

বিদায়ী জজ বলেন, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিনি বলে অনেকে আমার নামে কুরুচিপূূর্ণ মন্তব্যও করেছেন। কিন্তু আমি আইন ও সরকারি দায়িত্বের প্রতি অটুট ছিলাম। সরকার আমাকে যে দায়িত্ব দিয়ে এখানে পাঠিয়েছে, সেই দায়িত্ব আন্তরিকভাবে পালন করেছি। কক্সবাজারের অনেক কয়েদী অন্যান্য জেলার কারাগারে ছিল, যাতে আদালতে অনুপস্থিত দেখিয়ে ভিন্ন সুযোগ নেয়া হয়। আমি তা টের পেয়ে সেই সিস্টেম বাতিল করেছি। আমি সবসময় চেয়েছি জামিন করে দেয়ার নামে অসহায় মানুষকে হয়রানি তথা জামিন বাণিজ্য বন্ধ হোক।

ওসি প্রদীপের মৃত্যুদন্ড হওয়ায় কক্সবাজারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ হয়েছে দাবি করে বিদায়ী সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আরো বলেন, মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলাসহ কক্সবাজারের বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর মামলা নিষ্পত্তির কারণে তার নিরাপত্তা জনিত সমস্যার আশংকাও রয়েছে। মেজর সিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামি বরখাস্ত ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীরা নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বর্তমানে আইনজীবীদের অধিকাংশই জামিনের পেছনে দৌঁড়ান। তারা মুল মামলা পরিচালনা কিংবা ট্রায়াল শুনানি করেন না। তাদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।

উল্লেখ্য, সদ্য বিদায়ী সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল কক্সবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ও চাঞ্চল্যকর মামলা নিষ্পত্তিকারী জেলা জজ। কিন্তু সম্প্রতি বিধি বহির্ভূতভাবে কয়েকটি জামিন নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে উচ্চ আদালতে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থণার বিষয়টি কক্সবাজারে তার সাড়ে তিন বছরের অসংখ্য অর্জনকে চাপিয়ে গেছে। কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্ত সবার নজরে এসে তা নিয়ে চরমভাবে সমালোচিত হন বিচারক ইসমাইল। এরপরও এক সময়ে কক্সবাজার আদালতে জটে পড়া প্রায় ৮০ হাজার মামলা থেকে সাড়ে তিন বছরে ২৮ হাজার ৬০০ মামলা নিষ্পত্তিকে ইতিহাস হিসেবে উল্লেখ করছেন কক্সবাজারের আইনজীবী ও জেলা বিচার বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ।

কক্সবাজারের ১৭তম জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে তিন বছর ৬ মাস ৮ দিন দায়িত্ব পালন করা মুহাম্মদ ইসমাইল চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ভূজপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ম ব্যাচে এলএলবি অনার্সসহ এমএলএম সম্পন্ন করেন। পরে তিনি বিসিএস (জুডিসিয়াল) ১০ম ব্যাচের ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পান। কক্সবাজারে আসার আগে তিনি বান্দরবানের জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

কক্সবাজারে মাদকসহ আটকদের জামিন দিতে তার দায়িত্বকালে জামানত প্রথা চালু করেন তিনি। গত তিন বছরে আসামীদের জামিনের জামানত খাতে ১৮ কোটি টাকারও বেশি অর্থ জমা হয়েছে। যা অন্যান্য জেলার আদালতসমূহেও এখন অনুসরণ করা হচ্ছে।

তিনি গত তিন বছরে কক্সবাজারে প্রায় ২৯ হাজার মামলা নিষ্পত্তি করেন। এসব মামলা সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দায়রা মামলা (মাদক ও হত্যা মামলা)-৯৩টি, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল মামলা- ১৪৩টি, স্পেশাল মামলা ২টি, ক্রিমিনাল আপীল-১৯৭টি, ক্রিমিনাল ডিভিশন-৫৮৫টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়।

বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইলের সরকারি চাকরির বয়সসীমা পূর্ণ হওয়ায় তার করা আবেদনের প্রেক্ষিতে আইন ও বিচার বিভাগের বিচার শাখা-৩ এর উপসচিব (প্রশাসন-১) মোহাম্মদ ওসমান হায়দার স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে ৯ আগস্ট বুধবার তাকে কক্সবাজার থেকে বদলি করে তা চাকরি আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। আইন মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত মোহাম্মদ ইসমাইল সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী ১৪ আগস্ট (সোমবার) অবসরে যাবেন বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের জেলা নাজির বেদারুল আলম।

আরও পড়ুন

spot_img

সর্বশেষ