কক্সবাজার শহরের একটি আবাসিক হোটেলে হাত বেঁধে মাথা ও পায়ে ছুরিকাঘাত করে সাইফ উদ্দিন আহমেদ (৪৫) নামের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। বুকিংয়ের পর তার সাথে হোটেল কক্ষে যাওয়া যুবক রাত ৮টার দিকে হোটেলের কক্ষ থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে সাইফ উদ্দিনের বাইকটি নিয়ে চলে যাওয়ার সিসিটিভি ফুটেজের দৃশ্য ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর হতে ওই যুবক লাপাত্তা রয়েছেন। হোটেল কক্ষে মরদেহ পাওয়া গেলেও নিহতের ব্যবহৃত মুঠোফোন, মানিব্যাগ ও মোটর সাইকেলটির সন্ধান পায়নি পুলিশ।
সোমবার (২১ আগস্ট) সকালে শহরের হলিডে মোড়ের হোটেল সানমুনের দ্বিতীয় তলার ২০৮ নম্বর কক্ষ থেকে সাইফ উদ্দিনের হাত বাঁধা রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
এদিকে, উদীয়মান আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যার বিচারের দাবীতে কক্সবাজার শহরে বিক্ষোভ করেছে তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা।
নিহত সাইফ উদ্দিন কক্সবাজার পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ ঘোনার পাড়ার সাবেক আনসার কমান্ডার আবুল বশরের ছেলে। তিনি এলাকার কাদেদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি কক্সবাজার পৌর আওয়ামীলীগের গত কমিটির তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক এবং কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগসহ নানা ইউনিটের সাবেক ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি তিন ছেলে সন্তানের জনক।
হোটেল সূত্র জানায়, রোববার বিকেল ৫টায় সাইফউদ্দিন ও সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী এক যুবক হোটেলের ২০৮ নম্বর কক্ষ ভাড়া নেয়। এরপর রাতেই হোটেল থেকে বেরিয়ে সাইফ উদ্দিনের মোটর সাইকেল নিয়ে চলে যান ওই যুবক।
সোমবার সকালে নিহতের আরেক বন্ধু বৈরাম মোহাম্মদ ইলিয়াছ তাকে হোটেলে খুঁজতে আসেন। তাকে নিয়ে হোটেল ম্যানেজার সাইফউদ্দিনের ভাড়া নেয়া কক্ষে গিয়ে হুক বিহীন দরজা আটকানো পায়। দরজা ঠেলে রক্তাত মরদেহটি দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ।
হোটেল ম্যানেজার রেজাউল বলেন, ‘নিহত সাইফ উদ্দিন ও তার বন্ধুরা প্রায়ই সময় এ হোটেলে কক্ষ ভাড়া নিতেন। এই কারণে সাইফ উদ্দিন হোটেলের সকলের পরিচিত। কাজেই রোববার যখন তিনিসহ আরেকজন মাস্ক পরিহিত যুবক কক্ষ ভাড়া নিতে আসেন তখন আমরা শুধু নিহতের নামই খাতায় নথিভুক্ত করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘রোববার কক্ষ ভাড়া নেয়ার কয়েকঘন্টা পরেই সাইফ উদ্দিনের সাথে আসা অপরজন অর্ধভেজা পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় হোটেল থেকে বের হন। তিনি যাওয়ার সময় সাইফ উদ্দিনের মোটর সাইকেল নিয়ে গেছেন। যার ফুটেজ আমাদের সিসিটিভিতে সংরক্ষিত আছে।’
নিহত সাইফ উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত শহরের কলাতলীর বৈরাম মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, ‘আমরা (সাইফুদ্দিনসহ) প্রতিদিন বিকেলে হাটতে বের হয়। কিন্তু রোববার তার (সাইফ উদ্দিনের) সাথে আমার দেখা হয়নি। রাতে সাইফ উদ্দিনের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় নিহতের স্ত্রী আমার সাথে যোগাযোগ করেন। পরে আমি রাতে বিভিন্ন জায়গায় খবর নিই। সকাল বেলা সানমুন হোটেল আসি। এখানে এসে তার রক্তাত মরদেহ দেখতে পাই।’
নিহতের আরেক বন্ধু কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের ব্যক্তিগত সহকারি মোহাম্মদ আলী ছোটন বলেন, ‘সাইফের মৃতদেহ উদ্ধারের পর আমরা হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখি। সেই ফুটেজে সাইফের সাথে যাকে দেখা গেছে তার শারীরিক গঠন নিহতের দূর সম্পর্কের শ্যালক কায়সার হামিদ নয়নের মতো লাগছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাইফুর মরদেহ উদ্ধারের পর নয়ন ফেসবুকে হত্যাকারীর বিচার চেয়ে পোস্ট করলেও তাকে আমরা কয়েক দফা কল করে ঘটনাস্থলে ডেকেছিলাম। কিন্তু তিনি আসেননি। পরে শুনেছি পুলিশ তাকে হেফাজতে নিয়েছে।’
অপরদিকে, সোমবার বিকাল ৪টার দিকে ইংরেজিতে ‘কেএইচ নয়ন’ নামে ফেসবুক একাউন্টের পোস্টে লিখা হয়— ‘আমি নয়ন, নিজেও একজন আইন বিভাগের ছাত্র। আইনের একজন ছাত্র হিসেবে আমি শিখেছি, আদালত থাকতে আমি আইন কখনো নিজের হাতে তুলে নিব না। ঘটনার আসল রহস্য উৎঘাটন করা হওক এবং সিসি টিভি ফুটেজ ভালো করে দেখেন সবাই কি মিল আছে আমার সাথে। আমি এই হত্যাকাণ্ড বা এই ঘটনায় কোনভাবে সম্পৃক্ত নই। আমি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকলে আমি নিজেই আমার সাজা প্রার্থনা করছি। আর যারা আসল বিষয়টাকে ঢাকার জন্য মিথ্যে নিউজ প্রচার করছে তাদের কাছে অনুরোধ— চোখ থাকতেও অন্ধ না হয়ে আরেকটু ভালো করে দেখুন ফুটেজটা। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু বলার মত মানসিক শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছি।’
বিকেল ৫টা ৪মিনিটে কায়সার হামিদ নয়নের (‘কেএইচ নয়ন’) ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে প্রতিবেদকের কথা হয়। তখন তিনি সদর থানায় অবস্থান করছেন জানিয়ে বলেন, ‘আমি আনসার ভিডিপির ২১ দিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছি। সকাল হতে বিকেল ৫টা চলা প্রশিক্ষণে সোমবার সকালেও অংশ নিই। হঠাৎ এক সহপাঠীর মাধ্যমে সাইফউদ্দিন ভাই খুন হবার বিষয়টি জানার পর ছুটি নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। সিসিটিভিতে দেখা যুবক আমার মতো বলে প্রচার পাবার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ আমাকে ডাকলে আমি থানায় এসেছি। আমার সাথে আরো কয়েকজনকে ডাকা হয়েছে। কেউ কেউ চলে গেলেও আমি এবং সাইফু ভাইয়ের বন্ধু ইলিয়াছ এখনো (বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত) থানা থেকে বের হতে পারিনি।’
নিহতের ছোট ভাই মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমার বড় ভাইয়ের মৃতদেহ বিছানায় পড়ে থাকলেও তার সাথে হোটেলে উঠা যুবকের কোন খবর নেই। এছাড়া আমার ভাইয়ের মোবাইল, মোটরসাইকেলের সন্ধান পাইনি এখনো।’
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ স্বজনদের হস্তান্তর করা হয়েছে। কাউকে হেফাজতে নেয়া হয়েছে কি না তা বলার সময় এখনো হয়নি। ঘটনার সাথে কে বা কারা জড়িত, কেন এই হত্যাকাণ্ড এসব জানতে পুলিশ কাজ করছে। সব আয়ত্বে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সবকিছু জানানো হবে।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘নিহতের প্যান্টের বেল্ট দিয়ে হাত দু’টি বাঁধা ছিল। তার শরীরে তিনটি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হোটেলের সিসিটিভির ফুটেজ দেখে সাথে থাকাদের শনাক্ত করতে কাজ করতে পুলিশ। আশা করছি, খুব শিগগিরই এ হত্যার রহস্য উম্মোচন করতে পারব।’
এদিকে, সাইফ উদ্দিনের খুনিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে দলটি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে ২০০০ সালে ছাত্রলীগের দায়িত্বকালীন সময়ে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় আসামি হওয়া সফিউল্লাহ আনসারী, নাসির উদ্দিন ও ছোট ভাই কফিল উদ্দিনকে সাথে নিয়ে রবিবার দুপুরে হাজিরা দেন তিনি। এ মামলায় ৩ বছর কারাভোগের পর জামিনে এসে দীর্ঘ ২৪ বছর হাজিরা দিয়ে আসছেন-এ নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন তিনি।