আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে চট্টগ্রাম-১ সংসদীয় আসনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে শোনা যাচ্ছে নানা গুঞ্জন। এ আসনে আওয়ামীলীগের একাধিক প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও মনোনয়ন দৌড়ে কে এগিয়ে সেসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে বাংলাধারার মুখোমুখি হয়েছেন আইটি বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য মাহবুব রহমান রুহেল। সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছেন বাংলাধারা ডট কমের সিনিয়র রিপোর্টার শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: আপনার বাইরে যদি মিরসরাইতে কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়, আপনি সেটি কীভাবে নিবেন?
মাহবুব রুহেল: মিরসরাইতে কাকে নমিনেশন দেওয়া হবে, এটি আসলে দলীয় ব্যাপার। আমরা দল করি দেশের জন্য এবং দলীয় শৃঙ্খলা মেনে, চেইন অব কমান্ড যদি কাউকে সিলেক্ট করে অবশ্যই তা আমাদের মানতে হবে। যেমন, আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ৭ বারের সংসদ সদস্য ছিলেন। এর মাঝে আরো একজনকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছিলো। তখনো আমার বাবা উনাকে সার্পোট করেছেন, গাড়ি দিয়েছেন, ফান্ডিং করেছেন। সত্যি বলতে মূল ব্যাপারটা হলো কে ক্যারি করতে পারবে। শুধু নমিনেশন পেলে তো হবে না, নমিনেশন পেয়ে তাকে জয়ী হতে হবে।এছাড়া যাকে নমিনেশন দেওয়া হবে সে জনপ্রিয় কিনা সেটিও মাথায় রাখতে হবে। কেননা জনগণ ভোটের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করবে। সুতরাং মিরসরাইবাসী কাকে চায়, সে জনপ্রিয় কিনা, এই বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করছে কাকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। এছাড়া যার ভিশন আছে সে নমিনেশন পাওয়ার যোগ্য দাবিদার। আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সংসদ সদস্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।এরপর আবার সংসদ সদস্য হয়ে তিনি অবকাঠামো, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। এছাড়া একটা ভিশন নিয়ে মহামায়া সেচ প্রকল্প এবং মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল করেছেন, এগুলো বিশাল ব্যাপার। আর একজনের ভিশন না থাকলে এগুলো করা আসলে সম্ভব না।তাছাড়া মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়া, ভবিষৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখা,যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে পারবে তাদেরকে আসলে নমিনেশন দেওয়া উচিত। এখন তো দল অনেকে অনেক উদ্দেশ্য নিয়ে করে। কেউ দল করে তাদের একটা ক্ষমতাবলয় তৈরী করার জন্য আবার অনেকে করে পয়সাকড়ি কামানোর জন্য। সুতরাং এখানে দেখতে হবে আমার নিয়ত ঠিক আছে কিনা। মূল কথা হলো, যারা যোগ্য এবং দাবিদার তাদের প্রধানমন্ত্রী নমিনেশন দিবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাকে নমিনেশন দেন তাকে মেনে নিতে হবে। এখানে আসলে পরিবারতন্ত্র বলতে কিছু নেই। আর ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে হয়ে তো আমি কোনো ভুল করিনি। এটা ঠিক আছে যে আমি আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন থেকে রাজনীতি শিখেছি। ছোটবেলা থেকে উনার কষ্টটা আমরা দেখেছি। উনার উপর নিপীড়ন, জেল-জুলুমসহ যে অত্যাচার করা হয়েছে সে অত্যাচার কিছুটা হলেও আমাদের উপর দিয়ে গিয়েছে। উনার যে আর্দশ, উনি কেন জনগণের জন্য সময় ব্যয় করেছেন এই বিষয়গুলো আমাদের দেখা। ওই জিনিসগুলো দেখে মনে হয় জনগণের উপর আমাদের অনেক দায়িত্ব আছে, উনারা আমাদের তাকিয়ে আছেন।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে আপনি কতটুকু প্রত্যাশী?
মাহবুব রুহেল: আমি আসলে রাজনীতির জন্য রাজনীতি করি না। রাজনীতিতে বিচরণ করছি প্রায় ১৫ বছর ধরে। তবে রাজনীতিতে আসার মূল কারণ হলো আমার আব্বাকে যখন ২০০৭ সালে ওয়ান-এলিভেন সরকার কারারুদ্ধ করলো তখন কিছু লোক উনার ৪০ বছরের সাজানো বাগান মিরসরাইকে নষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। তখন আমাদের দলেরও কিছু লোক বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো। দেশের ও দলের জন্য ক্ষতিকর কিছু লোক আমার আব্বার অনুপস্থিতিতে পদ-পদবী পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মিরসরাইকে তো এভাবে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া যায় না। তখন আমি মাঠের রাজনীতিতে বেশি সক্রিয় হই, মানুষের পাশে দাঁড়াই। আমি আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে মাদকবিরোধী নানা সামাজিক কার্মকান্ড করে যাচ্ছি, মানুষকে সাহায্যে-সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করছি, পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি, স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা সামগ্রী দিয়েছি। যতটুকু পারছি, আমি করছি। তবে সংসদ সদস্য হতে পারলে আমি অনেক বৃহৎ পরিসরে কাজ করতে পারবো। সংসদে গিয়ে আমি তরুণদের কথা বলতে পারবো। তাই আমি যদি সুযোগ পাই সংসদে যাওয়ার তাহলে আমি আমার এবং আমার বাবার যে স্বপ্নগুলো এখনো বাকি আছে সেগুলো পূরণ করতে পারবো। একই সাথে আমি নতুনত্ব নিয়ে আসতে চাই। এছাড়া বর্তমান প্রজন্ম ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমি সুন্দর মিরসরাই গড়তে চাই। এজন্য আমি অনেক বেশী প্রত্যাশী।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: আপনি যদি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কোন বিষয়গুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে চান?
মাহবুব রুহেল: আমি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিবো পরিবেশকে। কেননা আমি মনে করি পৃথিবী এখন বিপদ সংকেতের মধ্যে আছে। আমাদের তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রীতে গিয়ে ঠেকেছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের এখনই সোচ্চার হতে হবে। যদি আমি সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ পাই প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি কাজ করতে চাই। একই সাথে উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য আমাদের কৃষি জমিগুলোকে রক্ষা করতে হবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মাদক থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করা। আমি এই বিষয়টির প্রতি অনেক বেশী নজর দিতে চাই। এছাড়া আমার খুব ইচ্ছে মিরসরাইয়ের পর্যটন শিল্প নিয়ে কাজ করা। কেননা মিরসরাইতে ইকো ট্যুরিজম এবং এডভেঞ্চার ট্যুরিজমের বিশাল সম্ভবনা রয়েছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি কাজ করতে চাই।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: প্রধানমন্ত্রীর সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় আপনার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বন্ধুত্বের শুরুটা কীভাবে হলো?
মাহবুব রুহেল: আমি আসলে মেট্রিক পরীক্ষা শেষ করে ১৬ বছর বয়সে দেশের বাইরে চলে যাই। যেখানে আমি এলিভেন-টুয়েলভ গ্রেড শেষ করে দ্যা ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করি। আমি স্নাতক শুরু করার এক বছর পর একই ইউনিভার্সিটিতে একই সাবজেক্টে পড়াশোনার জন্য সজীব ওয়াজেদ জয় ও সেখানে যায়। তবে জয় তখন ছিলো ভারতে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী। সে সময়টাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করে বললেন জয় যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে স্নাতক করতে তুমি একটু খেয়াল রেখো।তখন জয় এক বছর পর আমার সাথে একই ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করে। তখন আমরা একসাথেই পড়তাম। আমি ১৯৯৪ সালে স্নাতক শেষ করে ৩ বছর সেখানে আইটি সেক্টরে কাজ করেছি। ১৯৯৭ সালে আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই এবং দেশে ফিরে আসি। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বললেন তুমি যেহেতু দেশে আসছো তাহলে বাংলাদেশে আইটি নিয়ে কিছু কাজ করো। তখন আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুপ্রেরণায় একটি আইটি কোম্পানি শুরু করি। তখন জয়ও আমার সাথে ছিলো। কিন্তু সে পরে ক্যালিফর্নিয়াতে চলে যায় চাকুরী নিয়ে। সে সময়টাতে আমি আর জয় মিলে অনেকগুলো গাইড লাইন দিয়েছিলাম আইটি খাত নিয়ে। বিশেষ করে সজীব ওয়াজেদ জয় তার মা’কে বলেছিলো আমাদের কম্পিউটারের উপর ট্যাক্স উঠাতে হবে। তখন কম্পিউটারের উপর প্রচুর ট্যাক্স ছিলো। সময়টা ছিলো ১৯৯৯ সাল। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। আমরা দুইজন চেষ্টা করেছি কম্পিউটারের উপর ট্যাক্স কমানোসহ কম্পিউটার সহজলভ্য করতে। তখন স্যাটেলাইটের যুগ ছিলো কিন্তু সাবমেরিন অপটিক ক্যাবল বাংলাদেশে ছিলো না। যার ফলে বাংলাদেশ অনেক কাজ করতে পারতো না, ভারত সবকাজ নিয়ে যেতো। এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা দুইজন আইডিয়া দিলাম যে আমাদের সাবমেরিন ক্যাবলটা খুবই দরকার। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণ একজন নেত্রী, তিনি আমাদের বললেন দেখো আমরা এই সাবমেরিন ক্যাবেলে কীভাবে যুক্ত হতে পারি। পরে আমি আর জয় মিলে একটি বিষয়টি উদঘাটন করি যে, বিএনপি’র সময় নামমাত্র খরচে সাবমেরিন ক্যাবলে বাংলাদেশসহ ১২ টি দেশ সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিলো। কিন্তু তারেক জিয়া দেশের সিক্রেট ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে সেটি নেয়নি। এটি না নেওয়ার কারণে বাংলাদেশ কিন্তু ২০ বছর পিছিয়ে যায়। এরপর আমরা দুইজন অনেক চেষ্টা করে সিঙ্গাপুরকে রাজি করিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করি। এই কাজটা করার কারণে আমরা খুব দ্রুত ভিড়িও কনফারেন্স করতে পারছি, ইন্টারনেট অনেক সহজলভ্য হয়ে গিয়েছে এবং আরো নানাবিধ সুবিধা দেশের মানুষ পেয়েছে। এরপর সজীব ওয়াজেদ জয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা হওয়ার পর বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের রুপকল্পটা কিন্তু সজীব ওয়াজেদ জয় দিয়েছিলো। জয় প্রধানত যে কাজটি করেছে সেটি হলো কানেক্টভিটি। যার মাধ্যমে সবাইকে দ্রুত সংযুক্ত করা সম্ভব হয়। ফাইবার অপটিক, ফোর জি, ফাইভ জি এই বিষয়গুলো সজীব ওয়াজেদ জয়ের অবদান। যার সুফল হলো এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল, নেটওর্য়াক, হাই ব্যান্ডউইথ।এছাড়া সে এখনো অনেক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যেমন ফ্রিল্যান্সারদের সুযোগ সুবিধা দেওয়া, তাদের শিখানো। সুতরাং বাংলাদেশের আইটি খাতের মেরুদন্ডটা জয়ই সৃষ্টি করেছে সেখানে আমারও ভূমিকা ছিলো।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ডিজিটাল বাংলাদেশ রুপকল্পে আপনার সম্পৃক্ততার কথা শুনেছি, সে বিষয়টা জানতে চাই।
মাহবুব রুহেল: হ্যাঁ, তবে জয়ের অবদানটা সবেচেয়ে বেশী, আমি সহযোগী হিসেবে ছিলাম। তার সাথে কাজ করেছি। যতটুক উপদেশ দেওয়ার আমি দিতাম। তবে সাবমেরিন ক্যাবল নিয়ে আমি প্রচুর কাজ করেছি, তখন আমার উদ্দেশ্য ছিলো যেভাবে হোক এটাকে বাংলাদেশের সাথে সংযুক্ত করতে হবে। তখন আমরা নিজের অর্থ খরচ করে এই সাবমেরিন ক্যাবলে সংযুক্ত হয়েছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ পরিকল্পনার মূল কারিগর হলো জয়। আমি বন্ধু হিসেবে এবং সহযোগী হিসেবে পরামর্শ দিয়েছি, সহযাগিতা করেছি।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে কেমন স্নেহ করতেন এবং কেমন জানেন?
মাহবুব রুহেল: জয় আর আমি যখন একসাথে পড়তাম তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালীন আমেরিকায় যান। সে সময়টা ছিলো রমজান মাস। তখন আমি প্রধানমন্ত্রীকে গাড়ি নিয়ে ঘুরাতাম। টেক্সাসের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতাম। তিনি আমাকে বেশী স্নেহ করতেন, এখনো করেন। আমাকে অনেক উপদেশ দিতেন, যেমন— আমার একটি বিষয় এখনো মনে পড়ে, আমি উনার কারণেই মাষ্টার্স শেষ করি। যখন ওয়ান এলিভেন সরকার আসলো তখন তিনি আমাকে বললেন ক্রাইসিসের সময় মানুষের সুযোগ আসে। এখন তুমি মাষ্টার্সটা শেষ করে এসো। এরপর আমি উনার উপদেশ মেনেই ফিনল্যান্ড থেকে মাষ্টার্স শেষ করি। উনি আমার মেন্টর হিসেবে ছিলেন। এখন তো উনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তবুও এখনো দেখা হলে তিনি খোঁজ খবর নেন, অনেক বিষয় জিঙ্গাসা করেন।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: মনোনয়ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আপনার বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন কী ভাবছেন?
মাহবুব রুহেল: আমার বাবা ৭ বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ৫২ বছর ধরে তিনি রাজনীতি করছেন। বাবা বলেছেন তিনি আর সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে চান না। হয়তো আব্বার অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো কথাটা বলেছেন। এখন উনারা ভালো জানেন উনারা কি সিদ্ধান্ত দিবেন। তবে যদি উনারা মনে করেন যে রুহেল ঠিক আছে, রুহেল যোগ্য, তাহলে আমি এটাকে স্বাগতম জানাই। এটা আমার জন্য আর্শীবাদের।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: বাবার সাথে আড্ডায় রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয় কিনা? উনি আপনাকে কি কি পরামর্শ দেন?
মাহবুব রুহেল: এটা তো অবশ্যই হয়। আমরা দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলি। বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন অনেক গুরুত্ব বহন করছে সে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করি। চট্টগ্রামের রাজনীতি কথা হয়, অনেক আলোচনা হয়। আমার বাবা মিরসরাইকে নিয়ে তো সারাক্ষণ ভাবেন।প্রতিনিয়ত তিনি আমাকে বলেন, কোনটা করলে ভালো হয়। আমাকে পর্যটন শিল্প নিয়ে বলেন, কৃষি জমি গুলোকে রক্ষার কথা বলেন, ভূ-গর্ভ্স্থ পানির যে অভাব সেটি কীভাবে দূর কথা যায় এই বিষয়গুলো নিয়ে তিনি আমার সাথে আলোচনা করেন। উনি সবসময় একটি কথাই বলেন কীভাবে মিরসরাইয়ের মানুষকে সুরক্ষিত রাখা যায়। বিশেষ করে প্রতিনিয়ত নেতাকর্মীদের খোঁজ খবর রাখার জন্য আমাকে বারবার বলেন। জামায়াত-বিএনপি অবরোধের নামে যে নাশকতা করছে সেখানে নেতাকর্মীরা কেমন আছে সেটি জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। তিনি সবসময় একটি কথা বলেন, তুমি সবসময় তাদের পাশে থাকবে। বিশেষ করে দূর্গাপূজার সময় আমাকে বলেন, তুমি প্রতিটি মন্ডপে মন্ডপে গিয়ে মানুষের খোঁজ খবর নিবে। আমার আব্বা আমার রাজনীতির মেন্টর। তিনি আমাকে সবসময় উপদেশ দেন কীভাবে কি করতে হবে।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সন্তান হিসেবে আপনার অনুভূতিটা কেমন?নিশ্চয়ই অনেক গর্ববোধ করেন?
মাহবুব রুহেল: ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আমার বাবা। এই বিষয়টি আমার জন্য অবশ্যই গর্বের। উনার মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আমি। উনি মুক্তিযুদ্ধে যে অপারেশনগুলো করেছেন সে বিষয়গুলো সন্তান হিসেবে আমার জন্য অনেক গর্বের। উনার সাহসিকতা শুধু মুক্তিযুদ্ধে নয়, আমি অনেক জায়গায় আমার বাবার সাহসিকতা দেখেছি। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে উনার যে বিচক্ষণতা সেখান থেকে আমরা প্রতিনিয়ত শিখি। তিনি আমাদেরকে সবসময় একটি কথা বলতেন সেটি হলো গতকাল কেন কাজটি হয়নি, বলতেন না আজকে কিংবা আগামীকালের কথা। উনি একসাথে যেভাবে ব্যবসা সামলিয়েছেন ঠিক সেভাবেই রাজনীতি করেছেন। আমার বাবা একজন আত্মনির্ভরশীল মানুষ। যদিও আমার দাদা দেশের একশ শিল্পপতির মধ্যে একজন ছিলেন। তারপর আমার দাদা মারা যাওয়ার পর তেমন কিছু ছিলো না। আমার আব্বা ধীরে ধীরে আজকে এই পর্যায়ে এসেছেন। উনি আমাদের আত্মনির্ভশীল হওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। আমরা যখন দেশের বাইরে পড়তে যাই তখন কিন্তু আব্বা আমাদেরকে টিউশন ফি ছাড়া কিছু দিতেন না। বাকিটা আমি কাজ করে করে জোগাড় করেছি। অনেক সময় পিৎজা ডেলিভারি করেছি, অনেক কাজ করেছি। এই যে আত্মনির্ভরশীল হওয়া এটি কিন্তু আমার বাবার কাছ থেকে আমরা শিখেছি। আমার বাবা রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকার কারণে ওতটা সময় আমাদের দিতে পারেন নি। তবে যতটুকু সময় দিয়েছেন সেটাই আমাদের জন্য অনেক। আমার জীবনের সবচেয় বড় অনুপ্রেরণা আমার আব্বা।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আপনি অনেক কাছ থেকে দেখেছেন, আপনাকে বাবাকে উনি কেমন জানেন? প্রধানমন্ত্রী এবং আপনার বাবার সম্পর্কটা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মাহবুব রুহেল: আমার আব্বার সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কটা অন্যরকম। আশির দশকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন চট্টগ্রামে আসতেন আমার আব্বা উনাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। আব্বা নিজে গাড়ি চালিয়ে চট্টগ্রামের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যাননি। চট্টগ্রামের মিরসরাই, ফটিকছড়ি, পটিয়া, রাঙ্গুনিয়াসহ সব উপজেলার খবর এবং মহানগরের খবর আব্বা প্রধানমন্ত্রীকে জানাতেন। আমার বাবাকে উনি মোশাররফ ভাই, মোশাররফ ভাই বলেন ডাকেন। আব্বার সব কথা উনি শুনেন এবং সে কথাগুলো উনি রাখেন। যখন আমার বাবা মিরসরাই ইকোনোমিক জোনের কথা বললেন তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাথে সাথে সেটি লুফে নিয়েছেন। কারণ উনি জানেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন থেকে যদি এই প্রস্তাব আসে নিশ্চয়ই ভালো প্রস্তাব হবে। আব্বার প্রতি প্রধানমন্ত্রী অনেক শ্রদ্ধাশীল। আব্বাও উনাকে অনেক শ্রদ্ধা করেন এবং নিজের নেত্রী হিসেবে অভিহিত করেন। উনাদের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে যে চিন্তাভাবনা যে পার্টনারশিপ সেটি অনেক বেশী শক্তিশালী।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: রাষ্ট্রপতি হিসেবে আপনার বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের নাম আসছিলো বারবার? ওই ঘটনাটা যদি একটু শেয়ার করতেন?
মাহবুব রুহেল: রাষ্ট্রপতির বিষয়টি আসলে আমরা পত্রিকায় দেখেছি। বিভিন্ন মিডিয়ায় আব্বার নাম এসেছে। আমরা তেমন কিছু জানতাম না। তবে আমার আম্মা দোয়া করছিলেন যাতে আব্বা রাষ্ট্রপতি না হয়। কারণ আম্মা এতো সিকিউরিটির মধ্যে বন্দী হয়ে থাকতে চাইছিলো না। আব্বা সবসময় খুব ঘুরাফেরা করতে পছন্দ করতেন। তিনি মানুষের সাথে সময় কাটাতে চাইতেন। গান ম্যান, পুলিশ প্রটোকৌল এসব কিছু নিতে চাইতেন না।আব্বা হুটহাট মানুষের বাড়িতে চলে যেতে চান। কোথায় কে আছে, কার কত বছর হয়েছে উনি সব জানেন। অনেকদিন কারো সাথে দেখা না হলে উনি চলে যেতেন দেখা করতে। আব্বা রাষ্ট্রপতি হলেও সে স্বাধীনতাটা চলে যাবে বলে খুব একটা আগ্রহ ছিলেন না। তবে রাষ্ট্রপতি এটা অনেক বড় সম্মানের। তবুও আমরা অনেক খুশী আব্বাকে আমরা কাছে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটটির ডোমেইন আপনি নিয়েছিলেন এবং আপনি করেছিলেন ওয়েবসাইটি? বিগত ১৫-১৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আপনার নেপথ্য অবদানগুলো জানতে চাই?
মাহবুব রুহেল: আমি আসলে অনেক কাজে করেছি এবং করে যাচ্ছি মানুষের জন্য। তবে এটি আমি প্রচার করি না। যেটা করার দরকার সেটা করি।বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটির ডোমেইন আমি নিয়েছিলেন ১৯৯৭ কিংবা ১৯৯৮ সালের দিকে। তখন দেশে ওয়েবসাইট ছিলো হাতেগুনা কয়েকটা। বলতে গেলে ওয়েবসাইট বলতে কিছু ছিলোই না। তখন আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলি যে আমাদের একটি ওয়েবসাইট দরকার। তিনি আমাকে অনুমতি দিলে তখন আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটটি তৈরী করি। যেটির ডোমেইন অনেক পুরোনো এলবিড ডট ওআরজি। এছাড়াও সিআরআইকে প্রতিষ্ঠিত করার শুরুর দিকে আমি চারটা কম্পিউটার কিনে দিই। এরপর আমি আরো কয়েকটা স্ক্যানার মেশিন কিনে দিই। শুরুর দিকে আমি, জয় এবং জয়ের আরেকজন বন্ধু সুলাইকি মিলে আমরা তিন জন সেখানে কাজ করতাম। শুরুর দিকে আমাদের সিআরআই’র অফিস ছিলো সুধাসদনে। এরপর সেখানে অনেকেই যুক্ত হয়। আমি আমার কাজ শেষ হওয়ার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। শুরুর দিকে এই সিআরআইতে আমার অনেক অবদান ছিলো। এরপর বিএনপি সরকার অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে আমার অফিস রেড করেছিলো। তখন আমার অফিস থেকে বিএনপি জামাতের নির্যাতন, নিপীড়ন, খুনের বিভিন্ন তথ্য-চিত্রগুলো ক্রাইম এগেইনষ্ট হিউমিন্যাটি নামে ডিভিডি কিংবা সিডিতে সংরক্ষণ করতাম এবং আমরা সেগুলো সেখানে রেডি করতাম। এরপর সিডিগুলা বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠাতাম। যেমন—আমাদের মিরসরাইতে বিএনপি ৩৫ টা লাশ ফেলেছে এবং সারা বাংলাদেশে একের পর এক খুন করেছে। আমরা সেসব তথ্য-চিত্রসহ এগুলো সংরক্ষণ করে সিডি বানাতাম। তখন রেড করে আমার অফিস তছনছ করে দিয়েছিলো জামাত বিএনপি সরকার। এরপর ২০০৭ সালে ওয়ান এলিভেন সরকারের সময় আমি সাহস করে সুধাসদনে যাই তখন আমাকে প্রধানমন্ত্রী বলেন তুমি এখানে কেন আসো তোমাকে তো আর্মি ধরে নিয়ে যাবে। এর আগে আর্মি আমার আব্বাকে ধরে নিয়ে যায়। তখন আমি উনাকে বলতাম আপনি যদি কিছু উপদেশ দিতেন, উনি বলতেন শুধু চেয়ে থাকো, দেখো কি হয়। আমি সেখানে গিয়ে গিয়ে বসে থাকতাম। এরপর তো আর্মি উনাকেও ধরে নিয়ে যায়। তারপর জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে জাতিসংঘে লিখেছি, ইউরোপীয় ইউনিয়নে লিখেছি, ফিনল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্টের কাছে আমি চিঠি পাঠিয়েছি। এরপর তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের চার জন মেম্বার অব পার্লামেন্টকে বাংলাদেশে পাঠান।ওরা তখন ওয়ান এলিভেন সরকারকে প্রশ্ন করে যে মামলা না থাকা সত্ত্বেও কেন জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং দলীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হলো। এই ঘটনার পর ওয়ান এলিভেন সরকার আমার উপর চড়াও হয়ে যায়। তখন আমাকে দেশের বাইরে চলে যেতে হয়। এছাড়া আমি বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের সাথে প্রায় সময় দেখা করতাম। উনাদের সাথে আলোচনা করতাম কীভাবে জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং আমার বাবাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জেল থেকে মুক্ত করা যায়। আমি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ওয়ান এলিভেন সরকারের বিরুদ্ধে চিঠি পাঠাতাম, এডভোকেসি করতাম। তখন আমি ফিনল্যান্ডের যাওয়ার পর জয় আমার সাথে ফিনল্যান্ডে দেখা করতে আসে। আমরা দুইজন মিলে বাংলাদেশে নেতাকর্মীদের উপর অবিচারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করার চেষ্টা করেছি।
শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত: মিরসরাইবাসীর উদ্দেশ্য কি বার্তা পৌঁছে দিতে চান?
মাহবুব রুহেল: মিরসরাইবাসীর কাছে আমি বলতে চাই—আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ৫২ বছর মিরসরাইতে অনেক কিছু করেছেন।তিনি এতোগুলো বছর মিরসরাইবাসীর সুখে দুঃখে পাশে থেকেছেন। উনি শুধু জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে থেমে থাকেননি। উনি আন্দোলন সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষার মাধ্যমে মিরসরাইসহ চট্টগ্রামের গণামানুষের নেতা হয়েছেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তিনি এই মিরসরাইকে সাজিয়েছেন। আমার এখনো মনে আছে আমার আব্বা নির্বাচনী গণসংযোগ করার জন্য এক মাসে ২শ কিলোমিটার পায়ে হেঁটেছেন। এমন কোনো ঘর নাই, গ্রাম নাই, পাড়া নাই, ওয়ার্ড নাই আমার আব্বা যান নাই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট ছোট বাচ্চারাও আমার বাবাকে চিনেন। উনার এই ৫২ বছরের ধারাবাহিকতা যদি আমি ধারাবাহিক করতে পারি তাহলে অবশ্যই ধন্য মনে করবো। তবে উনার এতো কষ্টের সাজানো বাগানের কার্যক্রমগুলোকে ধারাবাহিক রাখা আমার দায়িত্ব। উনার এতো কষ্টের সাজানো মিরসরাই যদি অন্য কেউ এসে ধ্বংস করে দেয় তাহল এটি সত্যিই অনেক বেশী দুঃখজনক হবে।আমি কিংবা আমার পরিবার চাইলে জীবনে আরো বড় কিছু পারতাম। কিন্তু আমার বাবার স্বপ্ন ছিলো মিরসরাইকে ঘিরে। সে স্বপ্নকে আরো বাস্তবে রুপ দিতে এখন দায়িত্বভার আমার কাঁধে এসেছে। অবশ্যই এটা আমার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব বৃহৎ পরিসরে পালনের জন্য অবশ্যই সংসদ সদস্য হওয়া প্রয়োজন। এখন দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে আমাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন। আর দল যাকে নমিনেশন তাকে আমাদের জয়ী করে তুলতে হবে। এর চেয়ে বড় কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আবার প্রধানমন্ত্রী করতে হবে, না হলে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে যাবে।
ভিডিও: