ফেরদৌস শিপন »
সীতাকুণ্ড সোনাইছড়ী ইউনিয়নের কদমরসুল বিএম কনটেইনার ডিপোতে শনিবার রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও কেমিক্যাল কন্টেইনার বিস্ফোরণের ঘটনায় সারাদেশের মানুষ বাকরুদ্ধ। হায় রে জীবন! আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের যে কর্মীরা ছুটে এসেছিল জীবন বাঁচাতে, সেই জীবনও নিভে গেছে সীতাকুণ্ডে কদমরসুলে। এই ঘটনায় বাতাসে ভেসে আসছে লাশের গন্ধ, স্বজনদের কান্নার রোল বইছে হতাহতদের ঘরে ঘরে। ভারি হয়ে উঠছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের আকাশ। রোববার মধ্যরাত পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৯ জনে দাঁড়িয়েছে। একই সাথে আরো সাড়ে ৪ শতাধিক আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। সময়ের সঙ্গে বেড়েই যাচ্ছে মরদেহের সংখ্যা। হাসপাতালজুড়ে বাড়ছে স্বজনদের আহাজারি। মৃতের স্বজনরা মরদেহগুলো ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিয়ে যেতে আকুতি জানিয়ে দৌঁড়ঝাঁপ করছেন। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এটি দেশের সবচেয়ে বড় অগ্নিদুর্ঘটনা।
খালি চোখে এটিকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা হলেও এই দুর্ঘটার কারণ এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। অনেকে বলছেন, এরকম একটি সুরক্ষিত জায়গায় হঠাৎ করে এই ধরনের আগুন লাগার ঘটনা কিছুটা হলেও জনমনে সন্দেহ তৈরি করছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি নাশকতা কিনা সেটি নিয়েই এখন জল্পনা-কল্পনা চলছে। তাই ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের গঠিত কমিটিসমূহকে আলাদা আলাদাভাবে রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়েছে। মর্মান্তিক এই ঘটনায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের পক্ষ থেকে গভীর শোক ও সমবেদনা জানানো হয়েছে। সংসদেও নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
ইতোমধ্যে যারা মারা গেছে তাদের ক্ষতিপূরণসহ তাদের ছেলেদের চাকরি ও যারা আহত হয়েছে তাদের আমৃত্যু ক্ষতিপূরণসহ চাকরি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ডিপো কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। ভয়াবহ এ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সব কনটেইনার ছিল পণ্যভর্তি। ফলে আমদানি ও রপ্তানির জন্য প্রস্তুত বহু পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অগ্নিকাণ্ডে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য পুড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছুঁতে পারে।
আগুন লাগার পর রাসায়নিকের কন্টেইনারে একের পর এক বিকট বিস্ফোরণ ঘটতে থাকলে বহু দূর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। আগুন নেভাতে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা একযোগে কাজ করছেন। সেই সাথে কাজ করছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, সীতাকুণ্ড উপজেলা প্রশাসন, র্যাব, রেড ক্রিসেন্ট, সিপিপি ও স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনসহ গণমাধ্যমের কর্মীরা। তাদের মতে, দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ভয়াবহ আগুন এটি। আগুনের বেগ ও হতাহতের সংখ্যাটাও বিশাল। পাশাপাশি আগুন নেভাতে যারা এগিয়ে গিয়েছিলেন তারা বিস্ফোরণের কাছে হার মেনে হয়েছেন লাশ। রোববার দিনের বেলায় যাদের উদ্ধার করে নেয়া হচ্ছে তাদের অধিকাংশই ছিল মৃত। মৃত যাদের পরিচয় শনাক্ত হয়নি তাদের ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওমর ফারুক।
আমরা হাসপাতালে গিয়ে দেখেছি, ওষুধসহ বিভিন্ন সাহায্য সামগ্রীর কোন অভাব ছিল না। কেননা, একদল মানবিক কর্মী এ ঘটনায় নিহত ও আহতদের উদ্ধার এবং তাদের প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পণ্য সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে আসে। এটা ছিল মানবিকতায় চট্টগ্রামে অতীত ইতিহাসের একটি রেকর্ড। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। চট্টগ্রাম গাউছিয়া কমিটি নামে একটি সংগঠনের তৎপরতা সর্বত্র প্রশংসা কুড়িয়েছে। এরা আগুন লাগার শুরু থেকে রোববার বিকেল পর্যন্ত আহত-নিহতরা যাবতীয় কর্মে নিয়োজিত ছিল। স্মরণকালের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধদের রক্তদানসহ নানা সহযোগিতা দিচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীরা। শনিবার দিনগত রাত দুইটার দিকে বিভিন্ন হল ও আশপাশের মেসগুলো থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট এলাকায় জড়ো হন কয়েকশ শিক্ষার্থী। তবে রাস্তায় কোনো গাড়ি না থাকায় ঘটনাস্থল বা হাসপাতালে পৌঁছাতে বিপাকে পড়েন তারা। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বাসের ব্যবস্থা করা হয়। রাতেই শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে চমেক হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।
জানা গেছে, বিএম কনটেইনার ডিপোতে শত শত হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের ড্রাম ছিল। আগুন লাগার পর দ্রুতই একের পর এক ড্রাম বিস্ফোরিত হয়। রোববার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, বিস্ফোরিত নীল রঙের এসব ড্রামের বিচ্ছিন্ন অংশ বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কেমিক্যালভর্তি এসব ড্রাম বিস্ফোরণের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। এতে হতাহতের সংখ্যা ধারণার চেয়েও বেশি হতে পারে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা। ৩০ কেজি ওজনের এসব ড্রামে লেখা আছে, ৬০ শতাংশ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড।
সীতাকুণ্ডের স্থানীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলম বলছেন, ‘ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কীভাবে কনটেইনার ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থ জমা করা হয়েছে তা তদন্ত করা উচিত। সীতাকুণ্ডের স্থানীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্য অনুযায়ী আমরাও বলতে চাই, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কীভাবে কনটেইনার টার্মিনালে রাসায়নিক ডিপো করা হলো? কারা দিল এই অনুমোদন? কীভাবে দেওয়া হলো অনুমোদন। এই অনুমোদনের সব ধাপ কি সঠিকভাবে পার হয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাব সংশ্লিষ্টদের দিতে হবে। এবং অনিয়মের সাথে জড়িতদের কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। এজন্য অবশ্য বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটিগুলো যথাযথ প্রতিবেদন দেবে বলেই আমাদের আশাবাদ।
‘ডিপোতে যে দাহ্য পদার্থের কনটেইনার ছিল, সে সম্পর্কে আগে থেকে তাদের অবহিত থাকা উচিত ছিল। সাধারণ কনটেইনারের মধ্যে দাহ্য পদার্থের কনটেইনার ঢোকালে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? যারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তাদের কে অর্থসহায়তা দেবে?
আমরা চাই, মানুষগুলো এমন ট্র্যাজেডির শিকার হয়ে প্রাণ হারালেন, তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং যারা আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যবস্থা ইতোমধ্যে অনেকটাই হয়েছে, তবে আরও উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। এর পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেন এমন দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে।
প্রসঙ্গত: বিএম কন্টেনার ডিপোটি ২৪ একর জমি নিয়ে সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ির শীতলপুর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত। ডিপোটির কন্টেনার ধারণক্ষমতা ১০ হাজার টিইইউএস। এ গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপ স্মার্ট গ্রুপ।