কক্সবাজার প্রতিনিধি »
অবশেষে দ্বিতীয় দফায় ২১ ইয়াবা কারবারি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রত্যয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে কক্সবাজারের টেকনাফ সরকারি ডিগ্রি কলেজ মাঠে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক ফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়ে তাদের আইনের আওতায় নেন।
পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জেলা ও উপজেলা আওয়ামীলীগের নেতা, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের জেলা উপজেলা নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় ধর্মীয় নেতা ও সুধীজন উপস্থিত থাকলেও সরকারদলীয় স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন।
তেমনিভাবে অনুপস্থিত ছিলেন নিকট অতীতেও সীমান্ত উপজেলায় ক্ষমতার একছত্র অধিপতি সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, উপজেলা চেয়ারম্যান ও যুবলীগ সভাপতি নুরুল আলমসহ পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সিংহভাগ জনপ্রতিনিধি।
এসব বিষয় অনুষ্ঠানে আসা লোকজনের মাঝে নানা গুঞ্জনের সৃষ্টি করে। কি কারণে তারা অনুপস্থিত, অনেকে তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণও শুরু করে। অনেক জনপ্রতিনিধি নিজে এবং অনেকের স্বজনের নামে ইয়াবা সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকায় এলাকার জনহিতৈষী আয়োজন থেকে এসব জনপ্রতিনিধি বাদ পড়ছেন নাকি অন্য কোন কারণে নিজেদের আড়ালে রেখেছেন, তার হিসাব মেলাতে চেষ্টা চালান তারা।
অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রথমবার আত্মসমর্পণে সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির কয়েকজন নিকটাত্মীয়ও ছিলেন। এদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি চার্জশিটও দাখিল করেছে পুলিশ। তাছাড়া শুরু থেকেই গডফাদার হিসেবে বদির নাম এক নাম্বারে এসেছে বার বার। এসব কারণে গতবার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্থানীয় এমপি হিসেবে বদির উপস্থিতি নানা বিতর্কের জন্ম দেয়। তাই এবার হয়তো বিতর্কমুক্ত ভাবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান শেষ করতে সাবেক সাংসদ বদিসহ তার স্ত্রী বর্তমান সাংসদ শাহিন আরা বদিও বাদ পড়েছেন। একই অভিযোগ রয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলমসহ পরিচিত অন্যান্য আরো সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি।
তবে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, আমরা সবাইকে দাওয়াত দিয়েছিলাম। তারা কেন উপস্থিত হননি তা সঠিক বলা যাচ্ছে না।
গতবার এলেও এবার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে না আসার কারণ সম্পর্কে জানতে সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির বক্তব্য জানতে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু ফোন রিসিভ না হওয়ায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।
তেমনি ভাবে ফোনে সংযোগ না পাওয়ায অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতির বক্তব্য জানা যায়নি বদির স্ত্রী ও বর্তমান এমপি শাহিন আরা বদির।
বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগ সভাপতি নুরুল আলমের সাথে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে কোন উত্তর না দিয়ে চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, কিছু লোকজনের সাথে বৈঠকে আছি, আমি আপনাকে (প্রতিবেদককে) পরে ফোন দেব-এটি বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। কিন্তু এরপর আর ফোন দেননি এবং রিসিভও করেননি।
তাদের অনুপস্থিতি সম্পর্কে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘মাদক, জঙ্গীবাদ ও দূর্নীতি’ এ তিনের বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জিরোটলারেন্স নীতি রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সেই নীতি বাস্তবায়নে কাজ করছে পুলিশ। সীমান্তে ইয়াবার আগ্রাসন রোধই আমাদের ধ্যান-জ্ঞান। আমরা অভিযানের পাশাপাশি কারবারিদের অপকর্ম ছাড়িয়ে স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিতের চেষ্টাও চালাচ্ছি। প্রথম আত্মসমর্পণে ইয়াবায় অভিযুক্ত অনেকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সে থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার বিতর্কিতদেরি এড়িয়ে আত্মসমর্পণ কলুষমুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
এদিকে সাধারণ মানুষের অভিমত, শীর্ষ গডফাদরদের আত্মসমর্পণের আওতায় আনা হলে টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবা আসা বন্ধ হতো। আড়ালে-আবঢালে ঘাপটি মেরে থাকা গডফাদাররাই সীমান্তে টিকে থাকা ইয়াবা পাচারকারীদের সাহসের খোরাক যোগাচ্ছে হয়তো।
পুলিশ সূত্র জানায়, টেকনাফে ইয়াবা কারাবারিদের প্রথম আত্মসমর্পণ হয়েছিল ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারীর উপস্থিতিতে ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সেখানে সাবেক এমপি বদির চার ভাইসহ ঘনিষ্ট ১৬ আত্মীয় ছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও পৌরসভার কাউন্সিলর ছিলেন সাতজন। এছাড়া ছিলেন বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীও।
কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইয়াবা তালিকায় কক্সবাজারের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি আছেন ৭৩ জন। তাদের মাঝে প্রথম দফায় আত্মসমর্পণ করেছেন মাত্র ২৪ জন। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা টেকনাফ শিলবুনিয়া পাড়ার সাইফুল করিম ওরফে হাজি সাইফুল গতবছর পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। বেশ কয়েকজন বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলেও ওই তালিকার বেশির ভাগই আত্মসমর্পণ না করে এখনো গা-ঢাকা দিয়ে আছেন।
আর ৩ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দফায় ২১জন ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করছেন। এসময় তারা ২১ হাজার ইয়াবা, ১০টি এলজি ও ৩০টি তাজা কার্তুজ জমা দিয়েছেন। প্রথমবার ১০২ জন ইয়াবা কারবারির কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছিল তিন লাখ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা ও ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্র। তাদের সবার বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে টেকনাফ থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এদের মাঝে একজন কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন আর বাকি ১০১ জনের বিরুদ্ধে গত ২০ জানুয়ারি অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। সোমবার আত্মসমর্পণকারিদের বিরুদ্ধেও দুটি পৃথক মামলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২০১৮ সালের ৪ মে দেশব্যাপী মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হয়। এতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজারে নিহত হয়েছে ২১১ জন। তাদের মধ্যে দুই নারীসহ ৬২ জন রোহিঙ্গা রয়েছে। এ সময়ে ১ কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার ৫৭০ পিস ইয়াবাও জব্দ হয়। আটক হন ২ হাজার ৩৩৮ জন। এসব ঘটনা মাদককারবারিদের মনে আতংক সৃষ্টি করেছে। ফলে অনেক চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি গা-ঢাকা দিলেও চুনোপুটি অনেকে আত্মসমর্পণ করতে মরিয়া হয়ে ছুটেছেন।
বাংলাধারা/এফএস/টিএম/এএ













