রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও দাতা সংস্থার মাধ্যমে দেশের বাইরের এ সহায়তা অব্যাহত থাকলেও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য একরকম অচল। বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ, মাঝারি ও ছোট উদ্যোক্তাদেরও ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা নেমেছে। ব্যবসায়ীদের এলসি নেই বললেই চলে। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছে। মুদি দোকান-ফুটপাথে বেচাকেনা নেই। ব্যবসা না থাকায় মানুষের মধ্যে অর্থের প্রবাহও নেই। অনেকেই আবার সবকিছু বন্ধ করে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এখনও দেশে নতুন বিনিয়োগকারী আসেনি। কর্মসংস্থান বাড়ানোয় উদ্যোগ নেই। এমনকি চীন আশ্বাস দিলেও এখনো কিভাবে বা কি করবে জানায়নি। বর্তমান এই দুরাবস্থার প্রভাব আগামী ২/৩ মাস পর দেশকে অস্থিতিশীল করতে পারে। এতে কারখানার যেমন কাঁচামাল সঙ্কট দেখা দেবে, তেমনি এর সঙ্কটে কারখানার উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে মালিকরা, যা আগামীতে দেশের রফতানি আয়ের ওপরও প্রভাব ফেলবে।
পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি বাড়াবে। এদিকে আগের এলসির পেমেন্টে বকেয়া থাকায় বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশি অনেক ব্যাংক অনিশ্চয়তায় আছে। এতে বৈশ্বিক ট্রেড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। অবশ্য গত সেপ্টেম্বরে বিদেশি করেসপন্ডেন্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ড. আহসান এইচ মনসুর প্রথমবার গভর্নর হিসেবে তাদের সঙ্গে সভা করেছেন। যে কারণে আগামী ৫-৬ মাস ওই সব বিদেশি ব্যাংকের পেমেন্ট বকেয়া (ওভারডিউ) রয়েছে, সেগুলোর বিল আগামী ৫-৬ মাসের মধ্যে পরিশোধ করার ইতিবাচক আশ্বাস মিলেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবেও দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা ফুটে উঠেছে। বিবিএস’র মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ ও শেষ প্রান্তিকের ত্রৈমাসিক মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশে। রুহুল আমিন নামের এক ব্যবসায়ী জানান, তার পাঞ্জাবির কয়েকটি শো-রুম আছে। গত কয়েক মাসে বিক্রি নেই বললেই চলে। কর্মচারীদের বেতন দেওয়াই দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। উপায় না দেখে শো-রুমেই যাচ্ছেন না তিনি।
অথচ দেশে আমদানি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ কমে এসেছে। দুই বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ডলার প্রবাহও। তবে দেশের ব্যাংকগুলো বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে স্বস্তিতে নেই। এর কারণ, বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়েছে। এতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে বিড়ম্বনা রয়েই গেছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তার বক্তব্যে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আমদানির এলসি খোলা ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ কমে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। আর আগস্ট পর্যন্ত প্রথম দুই মাসে আমদানির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৩ শতাংশেরও বেশি। এলসি খুলতে বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে প্রশ্নে ব্যাখ্যা দেন এই ব্যাংক কর্মকর্তা।
তিনি জানান, ‘কান্ট্রি রেটিং’ খারাপ হওয়া দেশের ব্যাংকগুলোকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোর গ্যারান্টির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের এলসির গ্যারান্টির বড় অংশই দেয় মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাংকগুলো। ভারত ও ইউরোপ-আমেরিকার বৃহৎ ব্যাংকগুলোও কিছু এলসির গ্যারান্টর হয়। এজন্য বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য একটি ঋণসীমা অনুমোদিত থাকে। ওই কর্মকর্তা বলেন, এমনিতেই বাংলাদেশের কান্ট্রি রেটিং খারাপ। এর ওপর দেশের কিছু ব্যাংকের পরিস্থিতি বেশ নাজুক। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে খারাপ বার্তা যাচ্ছে। যে কারণে বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে। তাই এলসি খুলতে বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে এমনিতেই আমদানির চাহিদা কম। যে চাহিদা আসছে, বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে দেওয়ার কারণে সে এলসিও খোলা যাচ্ছে না।
তবে এক-দেড় বছর আগের তুলনায় বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে ডলারের সরবরাহ বেশ ভালো বলে জানান তিনি। সম্প্রতি ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে রয়েছে তারল্য সংকট। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে চলছে নানা নেতিবাচক প্রচার।
জানা গেছে, এসব কারণেই বিদেশি অনেক ব্যাংক বাংলাদেশের কিছু ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না। এমনকি আর্থিক সক্ষমতা বেশ ভালো ব্যাংকগুলোর জন্যও ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে তারা।
উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক মাশরেক ব্যাংক। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী এ ব্যাংকটি বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যাংকেরই এলসির গ্যারান্টর হয়। কিন্তু রাজনীতির পাশাপাশি ব্যাংক খাতের অস্থিরতার কারণে ব্যাংকটি বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকেরই ঋণসীমা বন্ধ করে দিয়েছে।
আরেকটি ব্যাংক জার্মানির কমার্স ব্যাংকের। ইউরোপের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা রয়েছে এই ব্যাংকের। আর সেই ব্যাংকও বাংলাদেশের কিছু ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না। একইভাবে ভারত, সিঙ্গাপুর, সউদী আরব, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু ব্যাংক ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে বলে ব্যাংক নির্বাহীরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, এলসি বাড়ানো এবং ব্যবসা-বাণিজ্যকে গতিশীল করতে ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কি কারণে এলসি কমছে, এক্ষেত্রে করণীয় কি তা দ্রুতই ঠিক করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। একই সঙ্গে এলসি (ঋণপত্র) ছাড়াই চুক্তিপত্রের মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আমদানির সুযোগ সহজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই আশাবাদী এলসি কমলেও দ্রুত সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সূত্র: ইনকিলাব