মোংলা বন্দরের সুবিধাদি সম্প্রসারণসহ ১৩টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। সম্প্রতি অনুমোদন দেওয়া এ প্রকল্পের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড, দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন হবে।
বন্দর সম্প্রসারণ ও ড্রেজিং কার্যক্রমপশুর চ্যানেলে সংরক্ষণ ড্রেজিং নামে একটি প্রকল্প চলমান। এছাড়া বন্দর চ্যানেলের ইনারবার ড্রেজিং শেষ হলে ৯.৫০ মিটার থেকে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ মোংলা বন্দর জেটিতে সরাসরি প্রবেশ করতে পারবে।
নতুন বছরের প্রথম মাসে মোংলায় বাণিজ্যিক জাহাজের আগমন বেড়েছে। বেড়েছে কনটেইনার পণ্যবাহী জাহাজের আগমনও। ফলে ব্যস্ত সময় পার করছেন বন্দরের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জাহাজের শ্রমিকরা। বেশি সংখ্যক জাহাজ আসায় বন্দরের আয়ও বেড়েছে।
বন্দরের কার্যক্রম ও পরিসংখ্যানমোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক মোঃ মাকরুজ্জামান জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে মোংলা বন্দরে ৪৯৬টি বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ এসেছে। এতে ৬৫ লাখ ৬২ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি কন্টেইনারবাহী জাহাজ থেকে ১২,০৮৩ টিইইউজ কন্টেইনার লোড-আনলোড এবং ১২টি গাড়ির জাহাজ থেকে ৬,৭৮১টি রিকন্ডিশন গাড়ি খালাস করা হয়। ২০২৫ সালের শুরুতে মোংলা বন্দরে জাহাজ আগমনের সংখ্যা আরও বাড়ছে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক মোঃ মাকরুজ্জামান আরও বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম চার দিনে এ বন্দরে ১৭টি বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ ভিড়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্দরের পোর্ট লিমিটেডের মধ্যে জেটিতে দুটি কন্টেইনারবাহী জাহাজসহ মোট ২০টি বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ অবস্থান করেছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাণপ্রবাহ এ বন্দরটি লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। বর্তমানে খাদ্যশস্য, সিমেন্ট ক্লিংকার, সার, মোটরগাড়ি, মেশিনারিজ, চাল, গম, কয়লা, তেল, পাথর, ভুট্টা, তেলবীজ, এলপিজি গ্যাস আমদানি এবং সাদামাছ, চিংড়ি, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, হিমায়িত খাদ্য, কাঁকড়া, ক্লে টাইলস, রেশমী কাপড় ও জেনারেল কার্গো রপ্তানির মাধ্যমে দেশের চলমান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগে ব্যবহারকারীরা (স্টেকহোল্ডার) সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
ব্যবসায়ীদের মতামতমোংলা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (সিএন্ডএফ) সভাপতি মোঃ মাহমুদ আহসান টিটো বলেন, মোংলা বন্দরের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এছাড়া নতুন প্রকল্পও একনেকে পাস হয়েছে, যা বন্দরের জন্য ইতিবাচক। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মোংলা বন্দর ব্যবহারে আরও বেশি আগ্রহী হবেন ব্যবসায়ীরা। তিনি মনে করেন, বন্দরের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় এখন মোংলা বন্দর ব্যবহারের উপযুক্ত সময়।
বিশেষজ্ঞদের মতামতখুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক মোঃ সামিউল হক বলেন, সম্প্রতি মোংলা বন্দরের সুবিধা বাড়াতে একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার। ‘মোংলা বন্দরের সুবিধাদির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ নামে চার বছর মেয়াদী এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে চীনের অর্থায়ন ৩ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা এবং বাকি অর্থায়ন সরকার করবে। এটি বন্দরের জন্য একটি বড় সুখবর।
গেল বছর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ পরিস্থিতি, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ডলার সংকট, বন্যা—সব মিলিয়ে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেও আমদানি-রপ্তানিতে রেকর্ড করেছে মোংলা বন্দর। এছাড়া নতুন বছরের প্রথম মাসেই পণ্য খালাসে বিদেশি জাহাজ আগমনের রেকর্ড গড়েছে মোংলা সমুদ্রবন্দর। আশা করা যাচ্ছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের অর্থনীতি আরও বিকশিত হবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্যমোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমান বলেন,
আমাদের প্রজেক্টগুলো আগামী ২৫ জুনের মধ্যে শেষ হবে। শুধু একটি প্রজেক্টের সময় বাড়ানো হয়েছে ডিসেম্বর পর্যন্ত।
জি-টু-জি জেটির জন্য একনেকে বিল পাস হয়েছে। উপদেষ্টা মহোদয়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে ২১৪ কোটি টাকা কমিয়ে এ প্রজেক্ট পাস হয়েছে এবং আমাদের এনওসি প্রজেক্টের কিছু রিভিউ পুনরায় করতে হবে।
ড্রেজিং কার্যক্রম দ্রুততার সাথে চলছে।ফ্রোজেন ফুডস রপ্তানিকারকদের মোংলা বন্দর ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
জুট মিল মালিকদের সাথে আলোচনা চলছে যাতে তারা পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে না গিয়ে মোংলা বন্দর ব্যবহার করেন।
ইপিজেড (বেপজা)-এর কর্মকর্তাদের সাথে পুনরায় আলোচনা হচ্ছে যাতে তারা মোংলা বন্দরের ব্যবহার অব্যাহত রাখেন।
বন্দরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঅবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি মোংলা বন্দরের পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। এতে বন্দরের গুরুত্ব আরও বাড়বে। সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক হাব তৈরির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নির্মাণ হচ্ছে আরও ছয়টি জেটি। এসব জেটি নির্মাণ সম্পন্ন হলে—
বাড়বে বন্দরের কার্যক্ষমতা ব্যবহারকারীরা পাবেন নিরবচ্ছিন্ন সেবা কমে আসবে কন্টেইনার খালাসের সময়
ফলে মোংলা বন্দর একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে মোংলা বন্দরে ৭৬টি বিদেশি জাহাজ আসে। আর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তা বেড়ে ৮২টি হয়েছে।